ধারাবাহিক- অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-১)

অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-১)

-দ্যুতিপ্রিয়া ও অর্কপ্রভ

 

(১)

ট্রেনটা যখন বিশাখাপত্তনম স্টেশনে থামলো তখন ভোর হয় হয়… অনিরুদ্ধর ঠেলাতে ঘুম ভাঙল শিবানীর। দু’ মিনিটের মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দেবে তাই দুজনে ঝটপট করে নেমে পড়লো ট্রেন থেকে। দুজনের কাঁধেই দু’টো ব্যাগ, হাতে একটা করে ট্রলি।
শিবানী ওরফে হ্যালি, পেশায় একজন ভূতত্ত্ববিদ্। আঠাশ বছরের রোগা, বব কাট চুল, জিন্স ছাড়া আপনি যদি একে অন্য কিছু পোশাকে কখনো দেখেছেন তাহলে ধরে নিতে হয় আপনার সেদিন লটারি কাটা উচিত। এর পিঠে যে কলেজ ব্যাগটা থাকে তার ভিতরটাকে আপনি ছোট খাটো একটি ল্যাবরেটরি বলতে পারেন।
অন্যদিকে অনিরুদ্ধ ওরফে আহান.. পেশায় সাংবাদিক‌। আঠাশ বছরের চশমা পরিহিত, লম্বা, গায়ের রং এক কালে বেশ ফর্সা ছিল কিন্তু এখন রোদে জলে পুড়ে কালোতে পরিণত হয়েছে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কাঁধে যে ব্যাগটা থাকে সেখানে খুঁজলে হিরে থেকে জিরে অব্দি সব পাওয়া যাবে.. হাতে একটা  ডি.এস .এল. আর ক্যামেরা।

আসলে ওরা দুই বন্ধু মিলে এসেছে বিশাখাপত্তনমের পাহাড় আর সমুদ্রের মেলবন্ধনকে চাক্ষুষ করবে বলে। প্রতি বছর ওরা দুই বন্ধু মিলে এরকম কয়েকটা ট্রিপ করে। তবে একটাই নিয়ম, এই সব ছুটিতে ওরা নিজস্ব পরিচয় ব্যবহার করে না। তখন ওরা শুধু আহান আর হ্যালি। দুজন পর্যটক, যাদের পৃথিবীর কোনা কোনা দেখার ইচ্ছা। এভাবে পরিচয় লুকিয়ে ভ্রমণের কারণ- একটাই.. এটা একটা খেলা, যে শেষ অব্দি নিজের পরিচয় সাথে বন্ধুর পরিচয় লোকাতে সক্ষম হবে সে জিতবে, অন্যজন হারবে, পানিশমেন্ট! যে হারবে, পরেরবার তাকেই দুজনকার ঘুরতে আসার সব খরচ দিতে হবে।

যাইহোক, তল্পিতল্পা গুটিয়ে যখন দুজনে স্টেশনের বাইরে এলো তখন পাখিদের কিচিরমিচির বেশ ভালো মতোই শুরু হয়ে গেছে। কোথাও থেকে অনবরত এক ঠাণ্ডা শীতল হওয়া ওদের মাথার চুলগুলোকে খালি এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। খিদেয় দুজনের পেটেই ততক্ষণে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে।হ্যালির মনের ভাবটা বুঝতে পেরে আহানই সামনের কচুরির দোকানে যাওয়ার প্রস্তাব দিলো। একটা তৃপ্তির হাসি হেসে হ্যালিও চললো তার সাথে। এবারের প্ল্যানটা হ্যালি করেছিল, ওর সমুদ্র পছন্দ হলেও আহানের আবার পাহাড় একটু বেশি কাছের। তাই বিশাখাপত্তনমে এসে এক ঢিলে দুই পাখি মেরে দেয় সে।
“জায়গাটা কিন্তু চমৎকার”- স্টেশনে পেট পুজোটা ভালো করে সেরে, গাড়িতে করে হোটেলের দিকে যাওয়ার পথে আহানই মন্তব্যটা করলো। উপরি পাওনা হিসাবে, আগে থেকে সব কিছু বুকিং থাকায় কোনো চিন্তা নেই। ” আইডিয়াটা কার সেটা দেখতে হবে তো…” সম্পূর্ণ credit সানন্দে নিজের কাঁধে নিজেই নিয়ে নেয় হ্যালি। অন্যদিকে আহানের সেসব দিকে খেয়াল নেই। এখন সে দু’চোখ ভোরে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করতে ব্যস্ত। অবশেষে হোটেলে পৌঁছে check in সেরে রুমে পৌঁছাতে এক ঘন্টা লেগে গেলো ওদের। রুমটা ভারী অদ্ভুত- আসল হোটেল থেকে একটু দূরে, একটা বড়ো ঘরের ভিতরে দু’টো আলাদা আলাদা ঘর, একটা বাথরুম, মাঝখানে একটা ড্রইং হল,আর পিছনের দিকে একটা বারান্দা। এরকম আরো দু’টো তিনটে রিসর্ট আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হ্যালি বাথরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার জন্য। ঘড়িতে সবে সকাল চারটে- ওদিকে আহান দরজাটা খুলে বারান্দায় আসে দাঁড়ালো। এই জায়গাটা ভারী সুন্দর‌। পুরো পাহাড়ের কোলে, মোটামুটি এক হাত দূর থেকেই গভীর খাদ, ওদিকে দূরে সারিসারি পাহাড় চূড়া… ছুটে গিয়ে ঘর থেকে dslr আর বাইনোকুলারটা নিয়ে এলো আহান। এই অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য বেশ ভালোভাবে ক্যামেরাবন্দি করে বাইনাকুলারে চোখ লাগলো আহান। পাহাড়ের কোলে দূরে একটা ঘন জঙ্গলের মতো দেখা যাচ্ছে। পুরো কুয়াশায় মোড়া… উফফফ দেখেই লোভ হয়ে যায়।
ফ্রেশ হয়ে দুজনেই হালকা কিছু খেয়ে একটু জিরিয়ে নিলো। শারীরিক বিশ্রামটাও দরকার। ঘন্টা খানেক পর, মৌনতা ভঙ্গ করে আহানই প্রথম বেরোনোর তাগাদা দেয়। যেহেতু সকালটা প্রায় শেষ আর পুরোটাই অচেনা অজানা একটা জায়গা তাই আজ দুজনে আশেপাশেটা ঘুরে একটা গাইড ঠিক করে রিসর্টে ফিরবে ঠিক হলো।
জায়গাটা সত্যিই অনবদ্য, একদিকে সমুদ্রের হওয়া শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে আর অন্য দিকে পাহাড়ের নৈসর্গ মনটাকে যেন প্রতিমুহূর্তে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। দুই বন্ধুর মধ্যে হ্যালি একটু বেশি চটপটে। ওর রেডি হতে বেশি সময় লাগে না। আহান রেডি হতে নিজের ঘরে গেল। হাতে বেশ খানিকটা সময় আছে দেখে হ্যালি বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। দূরের ওই জঙ্গলটার মধ্যে মানুষকে টানার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। পুরো মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছে হ্যালিকে। চোখ যেন ফেরাতেই পারছে না ওই জঙ্গলটা থেকে। সম্বিৎ ফিরলো,আহানের গলার আওয়াজে। dslr হ্যালিকে ধরিয়ে দিয়ে বললো, “স্নাপগুলো একবার দেখ- বারান্দা থেকে যা zoom ভিউ পেয়েছি না…অসাধারন! দুজনে একে অন্যের দিকে একবার তাকিয়েই বুঝে গেল কি চলছে দুজনের মাথায়। “কাল তবে ওখান থেকেই শুরু হোক, কি বলিস?” হ্যালির প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না আহান, শুধু হালকা হেসে সম্মতি জানালো। আশেপাশে খুব বেশি মানুষ নেই। ভাইজাগের মতো একটা প্রসিদ্ধ tourist destination যে এরকম নিরিবিলি আর মন্ত্রমুগ্ধকর হতে পারে সেটা এখানে না আসলে বিশ্বাসই হতো না ওদের। হাঁটতে হাঁটতে একটা ক্যামেরার দোকানের ওপর চোখ যায় আহানের। dslr-টার এক দিকের স্ট্রাপটার অবস্থা শোচনীয় তাই কিনে নেওয়াই ভালো। দোকানদার বেশ মিশুকে, হিন্দিতেই জিজ্ঞাসা করলো কবে ওরা এসেছে, কোথায় থাকছে, এরপর আর কোথায় কোথায় যাবে এই সব। হ্যালিও দু-এক কথার পর পাহাড়ের কোলে জঙ্গলটা দেখিয়ে ওটার ব্যাপারে জানতে চাইলো।
“উস জায়গাকা নাম হ্যায় ভায়ামাতাভি, “ডাৱকা জঙ্গল”, দূর সে বহুত হি খুব সুরাত হ্যয় লেকিন পাস কোই নাহি যা সকতা” এই বর্ণনায় ওদের দুজনেরই যাওয়ার ইচ্ছাটা আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেলো “আচ্ছা আপনার কোনো চেনাশোনা ভালো গাইড আছে? মানে যে একটু আশপাশটা ঘোরাতে পারবে বিশেষ করে ওই ভায়ামাতাভি জায়গাটা”-আহানের এই প্রশ্ন শুনে দোকানদার কেন জানি না অবাক হয়ে তাকালো ওদের দিকে, বললো “সাহাব মেরে ঘর জানে কে ওয়াক্ত হো গয়া হ্যায়। মুঝে অভি দোকান বন্ধ কারনা হোগা, আপকো কুছ ঔর চাইয়ে তো কাল শুভা লে লেনা… “
“কেমন যেন এড়িয়ে গেল না পুরো ব্যাপারটা!” হ্যালি আহনকে উদ্যেশ্য করে ফিসফিস করে বললো। আহানও ভ্রু দু’টো কুঁচকে বললো, “exactly” ওদিকে দোকানদার দোকান বন্ধ করে কোথায় যেন সরে পড়েছে। আকাশটাও অন্ধকার অন্ধকার করে এসেছে। ওরা আশেপাশের চায়ের গুমটিগুলোতে খোঁজ নেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনো ফলই পেলো না। সবাই কেমন এড়িয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা। একটু ভেঙে পড়লো ওরা। কিন্তু পরক্ষণেই আহান বললো “রিসর্টে চ তাড়াতাড়ি আমাদেরই যা ব্যবস্থা করার করতে হবে, কুছ পরোয়া নেই, যখন একবার ভেবে নিয়েছি তখন যাবই।” রাতে খাবারটা হ্যালি একটু আগেই অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। এখন দু’জনে মিলে ড্রইং রুমে বসে। হ্যালি মন দিয়ে ডাইরিতে কি সব যেন লিখছে আর মাঝেমাঝেই মোবাইলে কি সব দেখছে। ওদিকে আহানের চোখ ক্যামেরাতে আটকে। সকাল থেকে বিকালে ঘরে ঢোকার আগে পর্যন্ত যত ছবি তুলেছে সেগুলোই দেখতে ব্যস্ত। হঠাৎ হ্যালিই বলে ওঠে “একটু রিসার্চ করলাম বুঝলি জায়গাটা নিয়ে, তেলেগু ভাষায় “ভায়াম” হলো ভয় আর “আতাভি” মানে জঙ্গল। জায়গাটা এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার মতো দূরে। যাওয়ার রাস্তা একটাই যদিও সেটা খুব একটা খারাপ না। কিন্তু সাধারণ মানুষ সবাই ঐদিকটায় যাওয়াটা একটু এড়িয়ে যায়। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর তো ওদিকে যারা যারা গেছে তাদের নাকি আর কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। কথিত আছে একশো বছর আগে নাকি ওখানে একটা গ্রাম ছিল। একবার পাহাড় থেকে ধস নেমে পুরো গ্রামটাই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তার পর থেকে নাকি ওখানে অনেক অতৃপ্ত অশরীরিদের বিচরণ” কথাগুলো মন দিয়ে শুনে আহান ওর ক্যামেরা থেকে হ্যালিকে কিছু একটা দেখাতে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা ঝনঝন শব্দে দুজনেই কেঁপে উঠলো।”

(২)

“আওয়াজটা তোর ঘর থেকে এলো না” বলেই আহান ছুটলো হ্যালির ঘরের দিকে। একটা বেশ বড় সাইজের পাথর পড়ে আছে, তার গায়ে মানুষের মাথায় এক গুচ্ছ চুল দিয়ে বাঁধা একটা ব্রাউন রঙের কাগজ। সারা ঘর কাঁচের টুকরোয় ভরে গেছে। আহান দরজা খুলে বাইরে গিয়ে একবার দেখলো। কিন্তু কিছুই তো নেই কোথাও! আসলে হ্যালির রুমটা লোকালয়ের দিকে আর আহানেরটা বারান্দার পাশে।

হ্যালি কাঁচের টুকরোগুলোকে পাশ কাটিয়ে পাথরের টুকরোটার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেই আহান এসে বাধা দিল.. “দাঁড়া আমি দেখছি।”

কোনোরকমে পাথরে বাঁধা ব্রাউন কাগজটা তুলে নিয়ে ড্রইং রুমে এলো দুই বন্ধু। যা দেখলো, তাতে যে কোনো সাধারণ মানুষের রক্ত জল হয়ে যাবে। এতক্ষণ ওরা যেটাকে ব্রাউন রঙের কাগজ বলে মনে করেছিল ওটা আসলে শুকনো চামড়ার অংশ বিশেষ। কোনো মানুষ বা পশুর চামড়া কেটে সেটাকে রোদে শুকিয়ে বানানো হয়েছে। ভিতরে রক্ত দিয়ে লেখা,
“জিন্দা রেহেনা চাহতা হ্যায় তো ভাগ যা…”

ওদের দুজনেরই নার্ভ বেশ শক্ত। পালানো তো দূরের কথা দুজনেরই মাথায় জেদ চেপে গেল। শেষ না দেখে কিছুতেই নড়বে না এখান থেকে।
হ্যালিকে একটু অস্থির দেখে আহান বললো, “তুই বরং একটা কাজ কর, তুই আমার ঘরটা ব্যবহার কর‌ আমি আজ এখানেই থেকে যাচ্ছি‌।”
টেবিলের ওপর রাখা খাবারগুলো ততক্ষণে ঠাণ্ডা জল হয়ে গেছে। সেগুলোকেই গলাধঃকরণ করে যে যার জায়গায় শোবার তোড়জোড় করতে লাগলো। মিনিট দশেক পর আহান আড়চোখে দেখলো হ্যালি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আলোও বন্ধ। একটা গভীর দম ছেড়ে নিজের পিঠের ব্যাগটা কাছে টেনে নিল আহান। ছবিগুলো আরো একবার দেখা দরকার। সন্ধে বেলায় ফটোগুলোতে ও একটা জিনিস খেয়াল করেছে.. কি সেটা? সেটা নিজে ভালো করে না বুঝে হ্যালিকে কি বোঝাবে? ওদিকে হ্যালি ঘুমানোর চেষ্টা করলো বেশ খানিকক্ষণ ধরে। না মাথার মধ্যে দু’টো প্রশ্ন খালি ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে,
এক কিসের বা কার রক্ত…
দুই কিসের বা কার চামড়া…
নাহ্, এভাবে ঘুম আসবে না.. খুব সন্তর্পণে খাট থেকে উঠে ঘরের মধ্যে টেবিল লাম্পটা জ্বালিয়ে বসলো। ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বের করে নিয়ে এখন ও বসেছে পরীক্ষা করতে। এমনিতে ও পেশাগত দিক দিয়ে ভূতত্ববিদ হলেও,কাজের সূত্রে
প্রত্নতাত্বিক, জুওলজি, বোটানি,পদার্থ কিংবা রসায়নবিদ্যা সব বিষয়গুলোর ওপরই কম বেশি চর্চা থেকে যায়।

(৩)

কাজ করতে করতে কখন যে ভোর হয়ে গেছে দুজনের কেউই খেয়াল করেনি। হুস ফিরলো কলিং বেলের আওয়াজে। আহানই গিয়ে দরজাটা খুললো। ততক্ষণে হ্যালিও বেরিয়ে আসছে ঘর থেকে। হোটেল থেকে লোক এসেছে ওদের জাগানোর জন্য। কারণ পাহাড়ের কোলে ভোরের সূর্যোদয় একটা আলাদাই আকর্ষণ। আগের দিনের রাতের জানালায় কাঁচ ভেঙে যাওয়ার ঘটনাটুকু ছাড়া বাকি ঘটনাটা দুজনেই চেপে গেল। জানাজানি হলে হয়তো হোটেল কর্তৃপক্ষই এখানে ওদের থাকতে দেবে না।
একটা স্বর্গীয় সূর্যোদয় উপভোগ করতে না করতেই হোটেলের একজন কর্মচারী ওদের জলখাবারটা দিয়ে গেল। ব্রেকফাস্ট যেহেতু হোটেল বুকিং-এর সাথে কমপ্লিমেন্টারি তাই ওটা আর আলাদা করে order দিতে হয়না। যাই হোক আজ ওরা হোটেলে বলে রেখেছে, ওদের একটা ভালো গাইডের ব্যবস্থা করে রাখার জন্য। জলখাবার খেয়েই ওরা বেরিয়ে পড়লো। গাইডটা একটা বাচ্চা ছেলে, ওই বাইশ কি তেইশ বছর বয়স। নাম হিংলা। ভাইজাকের ব্যাপারে ওর মতো জ্ঞানী আর সাহসী চটপটে ছেলে নাকি আর নেই।

দুজনের মুখেই আগের রাতের ঘটনা একটা চিন্তার ছাপ ফেলেছে, কিন্তু বাইরের পরিবেশ দুজনেরই মনকেই ভালো করে দিলো। হিংলা ছেলেটা খুবই চটপটে। গাড়ির সাথে কথা বলাই ছিল। ওরা গাড়ির কাছাকাছি আসতেই হিংলা দরজা খুলে দিয়ে বললো ” উঠে পড়ুন দাদাবাবু দিদিমনি, আজ আপনাদের মাতাজির মন্দিরমে লেকে যাউজ্ঞা, বহুত জাগ্রত ও মন্দির”..হিংলার মুখে এরম বাংলা শুনে হ্যালি স্বভাবতই কৌতূহলী হয়ে ওঠে..গাড়িতে উঠে আহান জিজ্ঞাসা করায় হিংলাই বললো যে তার ছোটোবেলা কেটেছে গ্যাংটকে তারপর কাজের খোঁজে ও আর ওর ভাই ভাইজাকে চলে আসে। আহান আর হ্যালিকে বাংলায় কথা বলতে দেখে বুঝে যায় বাঙালি গেস্ট তাই ও বাংলাটাই জারি রাখে। হিংলা যদিও হেসে হেসেই কথা বলছে কিন্তু তার চোখে মুখে কোথাও যেন একটা দুঃখের ছাপ আছে সেটা এড়ালো না আহানের চোখ থেকে। হাজার হোক, সাংবাদিকের চোখ বলে কথা। গাড়ি একটা কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে মাঝারি গতিতে। মন্দির ছাড়া কাছেপিঠে আর কি কি দেখার আছে জানতে চাওয়ায় হিংলা বলে, “মন্দিরকে পাসমে এক তালাব হ্যায় দাদাবাবু, আর মন্দিরকা পিছেই ওই ভায়ামাতাভি জাঙ্গালটা” জঙ্গলের কথা শুনেই দুজনের চোখ চিকচিক করে উঠলো। হ্যালি যেন এরই প্রতীক্ষা করছিল। স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞাসা করে “আচ্ছা হিংলা, জঙ্গলটার ব্যাপারে একটু বলো তো। বাইরে থেকে এতো সুন্দর লাগে কিন্তু শুনেছি এখানকার মানুষ নাকি ভয় পায় ওই জঙ্গলে যেতে।” হ্যালির কাছ থেকে এই প্রশ্ন আসতে পারে, সেটা আশাই করেনি হিংলা। সে একটু সময় নিয়ে বলে, “ঠিক হি শুনেছেন দাদাবাবু-দিদিমণি, উস জঙ্গলমে কই জানা নেহি চাহতা। লোগ ডরতে হ্যায়”
“কিন্তু কেন? কি আছে ওখানে?” আহান আর চুপ না থাকতে পেরে হিংলাকে কথাগুলো জিজ্ঞাসা করেই ফেললো। হিংলা একটু ইতস্তত করছিল। তখন হ্যালি ওকে বলে “লুকানোর কিছু নেই হিংলা! তুমি আমায় দিদিমণি বলেছো না! বলো কি আছে ওখানে? আমরাও শুনতে চাই”
“দাদাবাবু দিদিমণি, আসালমে বাত হ্যায় কি..ওখানে মানুষ গেলে লটকে নেহি আতা। এখনো অব্দি আমাদের এই ভায়ামাতাভি থেকে চারজন লাপাতা… বাকি আশপাশ সে বহুত সারে মানুষ ভি উধারসে লটকে নেহি আয়ে। উনমে সে মেরে ভাইভি থা দিদিমনি!” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামে হিংলা। ওর চোখগুলো এখন ঘোলাটে হয়ে এসেছে, সাথে গলাটাও কেঁপে কেঁপে উঠছে।
“কি বলছো হিংলা, মানুষ লাপাতা? তোমার ভাই ও? তুমি পুলিশের কাছে যাওনি? তারা কি বলছে?” এতগুলো প্রশ্ন একসাথে করে আহান হাঁপাতে লাগলো। এতক্ষণে ও বুঝেছে হিংলার মুখে কেন কষ্টের ছাপ দেখেছিল প্রথমে।
হ্যাঁ, দাদাবাবু আমি বারণ করেছিলাম ওকে যেতে। লেকিন ও মেরা বাত নাহি মানা। অর এটা ভি শুনা যাতা হ্যায় কি পুলিশের কাছে গেলে জাঙ্গালকা কালা সায়া ঘরকে বাকি সবকে উপারভি পারতা হ্যায়।” হিংলার এই উত্তর শুনে আহান আর হ্যালি দুজনেই হতভম্ব হয়ে যায়। গাড়িটাও ইতিমধ্যে মন্দিরের সামনে চলে এসেছে। পাহাড় কেটে বানানো মন্দিরটা, সত্যি অসাধারণ হাতের কাজ কারিগরদের। দেখেই ওরা মুগ্ধ হয়ে গেলো। আহান তো dslr-এ চোখ গুঁজে রইলো। একটা মুহূর্তও যেন মিস করতে চায়না। এদিকে হিংলা সেখানকার ইতিহাস নিয়ে বলে চলেছে- মন্দিরটা নাকি ওই গ্রামটা ধ্বংস হয়ে যাবার প্রায় পঞ্চাশ বছর পর পাহাড় দেবীকে তুষ্ট করার জন্য তখনকার মানুষজনরা বানায়। মন্দিরটা বানাতে কমসে-কম দশ থেকে বারো বছর সময় লেগেছিল। মন্দিরের পিছনে হঠাৎ কি যেন একটা নড়ে উঠল না! নিজের অজান্তেই তড়িঘড়ি আহান বাইনোকুলারটা চোখে লাগলো। হ্যাঁ, ঠিক দেখছে সে, একটা মানুষ মন্দিরের পিছনে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে, মন্দিরের ঠিক পিছন থেকেই ভায়ামাতাভির জঙ্গলটা শুরু হয়েছে। জঙ্গলে ঢোকার মুখে পিছন ফিরে মন্দিরটাকে একবার প্রণাম করলো সে। আহান ভালো ভাবে লক্ষ্য করলো তাকে, সাধারণ আর পাঁচটা মানুষের মতোই কিন্তু চোখ দু’টো অস্বাভাবিক রকমের স্থির, হাঁটা চলার মধ্যেও একটা যান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট। যেন মনে হচ্ছে ওকে দিয়ে কেউ কিছু
করিয়ে নিচ্ছে। এইরকম একজনকেই কাল সন্ধ্যাবেলায় ওর ক্যামেরাতে তোলা ছবিগুলোতে দেখেছিল না?
“কিরে এত মন দিয়ে কি দেখছিস” হ্যালির প্রশ্নে আহানের সম্বিৎ ফেরে। আসল ব্যাপারটা লুকিয়ে গিয়ে হালকা হেসে বলে, “আরে না না, আসলে এত সুন্দর জায়গাটা কখন যে হারিয়ে গেছিলাম।”

 

চলবে…………

Loading

Leave A Comment